পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক কারা নির্যাতিত বিপ্লবী মহারাজ চক্রবর্তী ৫২তম প্রয়াণ বার্ষিক আজ


admin প্রকাশের সময় : অগাস্ট ৯, ২০২২, ৫:২৪ পূর্বাহ্ন /
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক কারা নির্যাতিত বিপ্লবী মহারাজ চক্রবর্তী ৫২তম প্রয়াণ বার্ষিক আজ

# আলি হায়দার (শাহিন) :-
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক মহা-নায়কের নাম। যিনি বিপ্লবী কাজের জন্য নেলসন ম্যান্ডেলা থেকেও বেশি জেল খেটেছেন। জীবনের ৩০টি বছর তিনি শুধু জেলেই কাটিয়েছেন। এছাড়াও আরও ৪/৫ বছর তিনি অজ্ঞাতবাসে কাটিয়েছেন। আজ সেই ইতিহাসের মহানায়কের ৫২তম প্রয়াণ বার্ষিক।
১৮৮৯ সালের ৫মে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা, বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার কুলিয়ারচর উপজেলার কাপাসাটিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম করেন তিনি।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এক পাতানো যুদ্ধে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মধ্য দিয়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষে ক্ষমতায়িত হয়। চূড়ান্তভাবে স্বাধীনতা হারায় ভারতবাসী। ছিনিয়ে নেওয়া সেই স্বাধীনতা ব্রিটিশদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে জীবনের সবটুকু সময় বিসর্জন দিয়েছেন ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী।
ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ চক্রবর্তী) ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বিপ্লবী। তিনি তার জীবনের পুরোটা শুধু মাত্র দেশ ও দেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে, কল্যাণের লক্ষ্যে উৎসর্গ করে গেছেন। যিনি দেশের কথা ভেবে, দেশের মানুষের কথা ভেবে চিরকুমার থেকে গেছেন, বিয়েটুকুও করেননি। তিনি দেশের জন্য, দেশের মানুষের মুক্তির জন্য, তার জীবনের মহামূল্যবান দীর্ঘ ৩০টি বছর শুধু জেলখানায় অতিবাহিত করেছিলেন। ১৯৬৭ সালে তার লিখিত গ্রন্থ ‘জেলে তিরিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “পৃথিবীতে সম্ভবত আমিই রাজনৈতিক আন্দোলন করার কারণে সর্বাধিক সময় জেলখানায় অতিবাহিত করেছি’। মাঝখানে দু-এক মাস বিরতি ছাড়া আমি টানা ৩০ বছর জেলখানায় কাটিয়েছি এবং ৪/৫ বৎসর অজ্ঞাতবাসে কাটাইয়াছি। জেলখানার পেনাল কোডে যেসব শাস্তির কথা লেখা আছে এবং যে-সব শাস্তির কথা লেখা নাই তাহার প্রায় সব সাজাই ভোগ করিয়াছি।”
তার জীবন বলেন যৌবন বলেন তিনি তার পুরোটাই কারাগারে কাটিয়েছেন। কিন্তু জেলে আটকে রেখে তার বিপ্লবী মনোভাবকে কখনো দাবিয়ে রাখতে পারেনি বৃটিশ সরকার। মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তিনি শুধু বিপ্লবীই ছিলেন তা নয়; ছিলেন একজন জনদরদী, দেশপ্রেমিক, সমাজসংস্কারক ও লেখক। মানুষের জন্য, দেশের জন্য যিনি সারা জীবন সহ্য করে গেছেন দুঃসহনীয় অত্যাচার। তিনি নিজেকে কখনো সফল বিপ্লবী বা মানুষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেননি। আজন্ম এই সংগ্রামী মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত ভারতবর্ষ ও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে নিজ দেশে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর বিপ্লবী চেতনার ইতিহাস হয়ত অনেকের জানা নেই। ভারতবর্ষে এখনো মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে আলোকবর্তিকা হিসেবে বিবেচনায় করা হয়। তার রাজনৈতিক আদর্শ বিপ্লবীদের এখনো উজ্জীবিত করে।
ভারত স্বাধীনতায় যেসব বিপ্লবী রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। দেশপ্রেম কেমন হতে হয় তার জীবনী পড়লেই বুঝা যায়। স্বচ্ছল জীবনে তিনি শুধু মোটা কাপড় পড়তেন, শুধু মাত্র দেশের পণ্য ব্যবহার করবে বলে। এমন দেশপ্রেমিক মানুষ, কোন কালে কয়েকজন আছে কিনা আমার জানা নেই।
তিনি বলতেন “আমার স্বপ্ন সফল হয় নাই, আমি সফলকাম বিপ্লবী নই। আমার ব্যর্থতার কারণ, আমার দুর্বলতা নয়। আমি কখনও ভীরু ছিলাম না-আমার জীবনে কখনও দুর্বলতা দেখাই নাই। আমি আমার চরিত্র নির্মল ও পবিত্র রাখতে সক্ষম হইয়াছি। অর্থলোভ আমার ছিল না। এক সময় হাজার টাকা আমার কাছে আসিয়াছে, কিন্তু সে টাকা নিজের ভোগ-বিলাসের জন্য ব্যয় করি নাই।
মৃত্যুভয় আমার ছিল না, যে কোনো বিপদজনক কাজে হাত দিতে আমি পশ্চাৎপদ হই নাই। আমার স্বাস্থ্য ভাল ছিল, আমি কখনও অলস ছিলাম না, কঠিন পরিশ্রমের কাজে কখনও বীত হই নাই, যখন যে কাজ করিয়াছি, আন্তরিকতার সাথে করিয়াছি।
আমার ব্যর্থতার কারণ পারিপার্শ্বিক অবস্থা, আমার ব্যর্থতার কারণ একজন দক্ষ ও সফলকাম বিপ্লবীর যতটা ধীশক্তি ও জন-গণ-মন অধিনায়কতার যে ব্যক্তিত্ব থাকা আবশ্যক তাহার অভাব”
তিনি সবসময় নিজেকে এমনি করেই বিচক্ষণতার সহিত উপস্থাপনা করতেন এবং তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন।
মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর শিক্ষা জীবনের শুরুর ইতিহাস জানা না গেলেও তিনি ১৯০৫ সালে ধলা হাই স্কুলে বছর খানেক পড়ালেখা করেন। এরপর ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলনের সময় অনুজ চন্দ্রমোহন চক্রবর্তী তাকে সাটিরপাড়া হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেই সময়ে বিপ্লবী দল গঠনের দায়ে ১৯০৮ সালে তিনি গ্রেফতার হলে প্রথাগত শিক্ষার ইতি হয়।
কর্মজীবন বলতে তিনি ১৯০৬ সালে ‘অনুশীলন সমিতির সাথে সরাসরি যুক্ত হন। বিপ্লবী দলে যুক্ত হয়ে দক্ষতার সহিত তিনি দলের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যান। তারপর এই বিপ্লবী কাজের জন্য ১৯০৮ সালে নারায়নগঞ্জ থেকে গ্রেফতার হন। সেখানে প্রায় ছয় মাস জেল খাটার পরে জেল থেকে ছাড়া পান। অতঃপর জেলে থেকে ছাড়া পাওয়ার পরই তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তিনি ঢাকায় আসলে সেখানে আবার আরেকটি মামলায় (ঢাকা ষড়যন্ত্র) মামলায় তাকে যুক্ত করা হয়। ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের হলে তিনি তার দলের নেতাদের পরামর্শে তিনি আত্মগোপনে কলকাতায় চলে যান। পরে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ১৯১২ সালে আবার তাকে আরেকটি হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়, পরে যদিও যথাযত প্রমাণের অভাবে কিছুদিন পরই তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
তারপর ১৯১৪ সালে তাকে আবারও ব্রিটিশ পুলিশের নির্দেশে গঙ্গার তীর থেকে গ্রেফতার করা হয়। তখন তাকে গ্রেফতার করেন এক বাঙালি অফিসার। গ্রেফতারের পর তাকে আবারো বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলার আসামি করা হয় এবং এই মামলায় তাকে দীর্ঘ দশ বছরের কারাদ- দিয়ে আন্দামানে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি প্রায় মৃত্যুর মুখে পতিত হোন।
১৯২৪ সালে আন্দামান সেলুলার জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের পরামর্শে তিনি দক্ষিণ কলকাতার জাতীয় স্কুলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯২৭ সালে তাকে আবারও ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে। ১৯২৮ সালে তাকে নোয়াখালি জেলার হাতিয়া দ্বীপে নজরবন্দী করে রাখা হয়, কারণ তখন তাকে ব্রহ্মদেশের মন্দালয় জেলে পাঠানো হয়েছিলো।
অতপর ১৯৩০ সালে তাকে আবারও ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেফতার করে, এখানে তিনি দীর্ঘ ৮ বছর জেলে কাটানোর পরে ১৯৩৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পান। তবে এই কারাবাসের ৮টি বছর, শান্তি হিসেবে তাকে বিভিন্ন জেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কুখ্যাত বকসারদের বন্দিশালায় রাখা হয়।
এরপর ১৯৪২ সালে ‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলনে যোগদানের কারণে আবার গ্রেফতার করা হয়। সেখানেও তিনি প্রায় ৪ বছর জেলে কাটানোর পর মুক্তি পায়। তারপর ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জন ও দেশ ভাগের পর তিনি মাতৃভূমি বাংলাদেশকেই বেছে নেন বসবাসের জন্য। এই সময় তিনি বাংলাদেশে বসবাস রত হিন্দুরা যেন দেশত্যাগ না করে চলে যায়, সে বিষয়ে জেলায় জেলায় গিয়ে প্রচারণা চালান। যা পূর্ব পাকিস্তানের সরকার তার এই কর্মকা- মানতে পারেনি। জব্দ করে দেয় তার পাঠানো চিঠিপত্র পর্যন্ত।
এরপর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিনি প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হোন। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনীমূলক বই ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারত স্বাধীনতা সংগ্রাম’। বইটি মুক্তির পরই পাকিস্তান সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে, এবং বইটিকে সে সময়ই ‘বিপদজনক বই’ হিসাবে তালিকাভুক্ত করে পাকিস্তান সরকার। পরে যদিও ১৯৮১ সালে বইটি আবার প্রকাশিত হয়।
তারপর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার তাকে দুই বছরের জন্য কারারুদ্ধ করে রাখে। তখন জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে তিনি মানসিক ভাবে খুব ভেঙ্গে পরেন এবং চলে আসেন গ্রামের বাড়ি কুলিয়ারচরের কাপাসাটিয়া গ্রামে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাঁপানী মারাত্মক রকম বেরে যায় এবং হৃদরোগ ধরা পড়ে। এমতাবস্থায় এক পর্যায়ে ১৯৭০ সালে ভারত চিকিৎসার জন্য পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে অনুমতি পায়। কিন্তু তিনি চিকিৎসা শেষে আর ফিরতে পারেননি। তিনি ঐ বছরের ৯ আগস্ট সেখানেই মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্যের অংশবিশেষ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী হেলিকপ্টারে করে ভারত বর্ষে ছিটিয়ে দেন।